ফিরছে ইলিশের রাজত্ব

Client Logo
  • গল্প লিখেছেনঃ  মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম
  • তারিখঃ 2017-04-18
  • ভিজিটঃ 1443
 
সিন্ধুপ্রদেশ জয় করে দিল্লি ফিরছেন মহম্মদ বিন তুঘলক। নদীপথে। হঠাৎই খামখেয়ালি সুলতানের ইচ্ছা হল মাছ খাওয়ার। তুঘলকী ইচ্ছা বলে কথা! বিরাট বিরাট জাল পড়ল জলে। উঠতে থাকল মাছ। অ্যায়সান খেতে লাগলেন বাদশা যে কালক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। পথিমধ্যে মৃত্যু।ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধি না পেলেও লোকমুখে কালবাহিত হয়েছে এই কিস্যা। কিন্তু জানা যায়নি, কী ছিল সেই মাছ, যার গভীর সম্মোহনে জীবনকেও একরকম বাজি রেখেছিলেন তুঘলক। সঠিক জানা না গেলেও মোক্ষম আন্দাজ কিন্তু করেছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম সৈয়দ মুজতবা আলি! লিখেছিলেন, অন্য কিছু নয়। নির্ঘাত ইলিশেই মজেছিল সুলতানের মন। সুরসিক সাহিত্যিকের মতে, ইলিশের টান এমনই যে বাহ্যজ্ঞান থাকে না। আর সেখানে হরিপদ কেরানি থেকে বাদশা— সকলেই একই রকম বিবশ! ইলিশ বড় প্রকৃতিনির্ভর মাছ, এর জন্ম-প্রজনন ও বৃদ্ধি প্রকৃতির সূক্ষ্মতারে বাঁধা। এর দেখা মিলবে না পুকুরে, খালে, হাওড় বা বাঁওড়ে। চাষ করে একে পোষ মানানোর চেষ্টা পণ্ডশ্রম ছাড়া আর কিছু নয়। ইলিশ সাগর জলে থাকলেও নদীতে আসে ডিম ছাড়তে। এরা স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কাটতে কাটতে ডিম ছাড়ে। এর ডিম মানে কিন্তু একটা ডিম না। একসাথে থাকে প্রায় ১০-১৫ লক্ষ ডিম। অর্থাৎ আপনি মজা করে যে ডিম ভাজটি খাচ্ছেন তা প্রায় ১৫ লক্ষ অনাগত ইলিশের ধ্বংশের কারণ। অথচ মাওয়া পদ্মার পাড়ে এই ভাজা ডিমের দাম মাত্র ৪০ টাকা। গত কয়েক বছর ধরে মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে-পরে ১১ দিন ইলিশ ধরা বন্ধ রাখা হত। ২০১৫ সাল থেকে তা বাড়িয়ে ১৫ দিন করা হয়েছে।  সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক ২৫ ই সেপ্টেম্বর থেকে ৯ অক্টোবর পর্যন্ত নদীতে ইলিশ মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। বরিশাল জেলার নদীবেষ্টিত একটি দ্বীপসদৃশ উপজেলা মেহেন্দিগঞ্জ। জেলা প্রশাসক, বরিশাল জনাব  ড গাজী মোঃ সাইফুজ্জামান স্যারের প্রত্যক্ষ তত্বাবধানে  মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার কাজী মোঃ আলিমউল্লাহ  স্যার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার সকল জেলেদের প্রতিদিনই কোন না কোন মিটিং এ ডেকেছেন এবং এই নিষিদ্ধ সময়ে ইলিশ মাছ ধরা থেকে বিরত থাকতে তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেছেন। আলোচনা, তদারকি, ভৎসনা, ইউএনও স্যার কর্তৃক পরিচালিত মোবাইল কোর্ট  ইত্যাদি সব করেও কেন জানি থামছিলো না ইলিশ মাছ ধরা। মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় কোন সহকারী কমিশনার (ভূমি) দ্বায়িত্বে না থাকায় ইউএনও স্যার মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করার জন্য জেলা প্রশাসক স্যারকে ডিসি অফিস থেকে একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পাঠানোর জন্য অনুরোধ করলেন। জেলা প্রশাসক স্যার আমাকে মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় পাঠালেন।  যাওয়ার আগমূহূর্তে ডেকে বলে দিলেন যে স্বাভাবিকভাবেই জেলেরা গরীব। কিন্তু দেশের বৃহত্তর স্বার্থে যতটুকু সম্ভব নমনীয় থেকে হার্ড লাইনে যাও। কঠোর ব্যবস্থা না নিলে এই অবস্থার পরিবর্তন আনা যাবে না। ডিসি স্যারের এই উপদেশ নিয়ে ২৯ সেপ্টেম্বর গেলাম মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায়। ইউএনও স্যার আরেকবার চলমান পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিলেন। শুরু হল সারারাত মেঘনা নদীতে টহল। সাথে থাকে ৪-৫ জন পুলিশ এবং উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু বিশ্বাস। যাই হোক, রাতে ধৃত অভিযুক্ত জেলেদের সকালে মেহেন্দিগঞ্জ থানায় নিয়ে এসে আইন মোতাবেক জেল-জরিমানা করি। ২ রা অক্টোবর, ২০১৫। অন্যান্য রাতের মত মোবাইল কোর্ট টীম নিয়ে নদীতে টহল দিচ্ছি। রাত আনুমানিক ৩ ঘটিকার সময় ২০-২৫ টি নৌকা নিয়ে শতাধিক জেলে আমাদের মোবাইল কোর্ট টীমকে ধাওয়া করলো। ফাঁকা গুলি ছুড়ে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলো। আমি ইউএনও স্যারকে ফোন করলাম। স্যার পিছু হটে যাওয়ার উপদেশ দিলেন। বললেন, “চলে আসো। ওরা কাদের লোক তা জানা আছে। সকালে ফয়সালা হবে।” আমি স্যারের পরিকল্পনা ধরতে পেরে উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে আমার সিদ্ধান্ত জানালাম এবং মোবাইল কোর্ট টীম নিয়ে ইউএনও স্যারের বাসায় ফেরত আসলাম। ইউএনও স্যার তখন অন্য একটি টীম নিয়ে ইলিশা নদীতে টহল দিতে বেরিয়েছেন। আমি আর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ইউএনও স্যারের ফেরত আসার অপেক্ষা করছি। আনুমানিক ৪:৩০ ঘটিকার সময় ইউএনও স্যার ফেরত আসলেন। স্যার এসেই আমাদের দুজনের সাথে আলোচনায় বসলেন। স্যার বললেন যে আমাদের ধাওয়াকারী জেলেদের দলটি আলতাফ শিকদারের পাঠানো। আলতাফ শিকদার মেহেন্দিগঞ্জ থেকে যত ইলিশ মাছ দেশের অন্য জায়গায় যায় তার ৭০ ভাগ সরবরাহ করে। স্যার বললেন যে, আজ সকালে আলতাফ শিকদারের বাড়িতে হানা দিবো। কারণ রাতে ধরা পড়া সব ইলিশ এতো অল্প সময়ে অন্য কোথাও সরানোর সম্ভাবনা কম। সারারাত টহল দেওয়ারর কারণে ইউএনও স্যার কিছুটা ক্লান্ত। তাছাড়া আমি নিজেই এই অভিযানের নেতৃত্ব দিতে চাচ্ছি। তাই আমি স্যারকে অনুরোধ করলাম স্যার যেন আমাকে এই অভিযানটি পরিচালনার দ্বায়িত্ব দেন। স্যার প্রথমে দিতে চাচ্ছিলেন না। কিন্তু পূর্বের রাতের ঘটনার জন্য এবং মৎস্য ডিপার্টমেন্টের আরেকজন কর্মকর্তার কাছে আমার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল রাখার জন্য আমাকেই উক্ত অভিযানেন নেতৃত্ব দিতে সম্মত হলেন। ইউএনও স্যার আরও ৮ জন পুলিশ ও একজন এস আই কে সকাল ৭ টার মধ্যে পাঠানোর জন্য থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি)-কে নির্দেশ দিলেন। সকালের জন্য অপেক্ষা। অবশেষে সকাল ৭ টায় ১২ জন পুলিশ, একজন এস আই ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে সঙ্গে করে  আমি মোবাইল কোর্ট টীম নিয়ে আলতাফ শিকদারের বাড়িতে গেলাম। ইউএনও স্যার স্থানীয় কয়েকজন সাংবাদিককে আলতাফ শিকদারের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বলে দিয়েছিলেন। যাই হোক, আলতাফ শিকদারকে বাড়িতেই পেলাম। বাড়ি তল্লাশি করে বাড়ির পেছন থেকে ইলিশ মাছভর্তি তিনটি বিশাল ড্রাম উদ্ধার করলাম যাতে ইলিশের পরিমাণ হবে আনুমানিক ২০ মণ। অভিযুক্ত আলতাফ শিকদার মৎস্য রক্ষা ও সংরক্ষণ আইন, ১৯৫০ এর ৪ ধারা ভঙ্গ করার অপরাধে একই আইনের ৫ ধারায় ১ (এক) বছরের বিনাশ্রম কারাদন্ড ও ৫০০০ (পাঁচ হাজার) টাকা অর্থদন্ড প্রদান করলাম। একইসাথে উল্লিখিত আইনের ৫ক ধারায় তল্লাশীতে প্রাপ্ত ইলিশ মাছ জব্দ করার জন্য সাথে আসা পুলিশ সদস্যদের নির্দেশ দিলাম। জব্দকৃত ইলিশ এলাকার ২ টি মসজিদ, ৪ টি মাদ্রাসা ও স্থানীয় গরীব লোকজনের মাঝে বিলিবন্টন করে দিলাম।  সাংবাদিকদের ক্যামেরা গুলো সব চলছে! শেষ করলাম এক বছরের চাকুরি জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর একটি অভিযান। ধন্যবাদ মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার ইউএনও স্যারকে। ১৯ শে আগস্ট, ২০১৬। এগারো মাস পরের ঘটনা। তখন আমি ঢাকায়  বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারদের জন্য আবশ্যক ছয় মাসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে। বর্ষা শেষের পথে। পত্রিকা মারফত জানতে পারলাম দেশে তখনো ইলিশ উৎসব চলছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৪ লাখ টনের বেশি ইলিশ উৎপাদন হয়েছে যার কারণে দেশের সকল প্রান্তের মানুষ সস্তায় ইলিশ খেতে পারছে। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে দেশে ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন ইলিশ উৎপাদিত হয়েছিল। খবরটি পড়ে কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লাম। এই ভালো লাগাটুকুর জন্যই দিনের পর দিন কাজ করে যেতে পারবো। মোবাইল কোর্ট চলুক, নিশ্চিত হোক এদেশের মানুষের জন্য আমাদের দেওয়া সেবার প্রতিশ্রুতি।

 প্রিন্ট