বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, একজন আবু বকরের আর্তনাদ এবং আমাদের করণীয়…

Client Logo
  • গল্প লিখেছেনঃ  সুখময় সরকার
  • তারিখঃ 2017-04-21
  • ভিজিটঃ 1713
 
০৯ মার্চ, ২০১৫। সোমবার। আনুমানিক সকাল ১০:০০টা। শায়েস্তাবাদ ইউনিয়ন ভূমি অফিস পরিদর্শন শেষে বরিশালের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জনাব মোঃ শহীদুল আলম নিজ অফিসে ঢুকছেন। সাথে আমি (স্টাফ অফিসার ), জেলা প্রশাসক মহোদয়ের দেহরক্ষী তাওহীদ আর অফিস সহায়ক কাশেম। সিঁড়ি দিয়ে উঠার সময় হঠাৎ একজন ব্যক্তি পুরানো বিবর্ণ কিছু কাগজ আর কিছু ঔষধপত্র নিয়ে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের পায়ের কাছে পড়ে আর্তনাদ করতে লাগলেন। জেলা প্রশাসক মহোদয় প্রথমে ব্যক্তিটিকে শান্ত হতে বললেন এবং খুবই আন্তরিকভাবে ব্যক্তিটিকে তার সমস্যার কথা বলতে বললেন। জেলা প্রশাসক মহোদয়ের আন্তরিকতায় ব্যক্তিটি যেন একটু আশ্রয় ও ভরসা পেলেন। বিবর্ণ, কান্নাবিজরিত মুখটিতে যেন মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্য উকি দিল। ব্যক্তিটি তার নাম আবু বকর বলে জানালেন। বাড়ি পিরোজপুর জেলার নেছারাবাদ (স্বরূপকাঠী) উপজেলায়। স্ত্রী হালিমার চিকিৎসার জন্য বরিশাল এসেছেন। পক্ষাঘাতগ্রস্থ হালিমা গত ২মাস ধরে চিকিৎসাধীন আছেন বরিশাল নগরীর প্যারেরা রোডের বেলব্যান ফিজিওথেরাপি সেন্টারে। প্রতিদিনের ফিজিওথেরাপি চার্জ ১,০০০ টাকা। প্রতি সপ্তাহেই ডাক্তার সিটিস্ক্যান, এক্স-রে সহ বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে বলেন। সকল পরীক্ষা করতে হয় নগরীর মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। প্রতি সপ্তাহেই ১৫,০০০ টাকা থেকে ২০,০০০ টাকার পরীক্ষা করাতে হয়। এই পর্যন্ত ঔষধ খরচ সহ প্রায় ৩,০০,০০০ টাকা খরচ হলেও রোগীর অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। এখন সকল চিকিৎসা খরচ পরিশোধ করে হালিমাকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাইলেও বেলব্যান ফিজিওথেরাপি সেন্টার কর্তৃপক্ষ অতিরিক্ত আরো ১,০০,০০০ টাকা দাবী করে হালিমাকে আটকে রেখেছে। ইতিমধ্যে আবু বকরের যা সহায় সম্বল ছিল তা প্রায় শেষ। জেলা প্রশাসক মহোদয় আবু বকরের সকল কথা শুনলেন। স্টাফ অফিসার হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দিলেন বিষয়টি খতিয়ে দেখার জন্য। অনৈতিক, অযৌক্তিক কিংবা অন্যায় যদি হয়ে থাকে এবং তা যদি মোবাইল কোর্টে বিচারযোগ্য হয় তবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আমাকে নির্দেশ দিলেন। আমি তৎক্ষনাৎ কতোয়ালী মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে মোবাইল কোর্টের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে একজন এস.আই সহ প্রয়োজনীয় পুলিশ সদস্য প্রেরণ করতে বলি। অন্যদিকে সিভিল সার্জন মহোদয়কে অনুরোধ করি যেন তিনি অভিযোগ দায়েরেরর জন্য উপযুক্ত কোন প্রতিনিধি পাঠান। সিভিল সার্জন মহোদয় ইতিবাচক সাড়া দিলেন। আধঘন্টার মধ্যেই পুলিশ ফোর্স এবং ডেপুটি সিভিল সার্জন ডাঃ খালিদ মাহমুদ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে এসে পৌছান। বেঞ্চ সহকারী জনাব মোঃ কামরুজ্জামান ও অফিস সহায়ক মহসিন মোবাইল কোর্টে সহায়তার জন্য আমার সাথে রওনা দিল। আর সাথে সেই অসহায় আবু বকর। নগরীর প্যারেরা রোডের বেলব্যান ফিজিওথেরাপি সেন্টারে পৌছামাত্র দেখি হালিমার মত আরো প্রায় ২০ জন রোগী ওখানে চিকিৎসাধীন। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং রোগীদের জন্য পর্যাপ্ত জায়গার অভাব লক্ষিত হলো। মোবাইল কোর্টের উপস্থিতিতেই ডেপুটি সিভিল সার্জন মহোদয় প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন সনদ এবং কর্তব্যরত নার্স ও স্টাফদের নিবন্ধন সনদ দেখতে চাইতেই বেরিয়ে আসলো বাংলাদেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রকৃতরূপ। নিবন্ধনবিহীন এই প্রতিষ্ঠানটিতে নিবন্ধনবিহীন নার্স ও স্টাফরা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন। কোন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তো দূরের কথা কোন ডাক্তারই নাই। রোগীদের কোন নিবন্ধন বহিঃ সংরক্ষণ করা হয়না। কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার সাহেব (প্রতিষ্ঠানের অন্যতম একজন মালিকও বটে) উপস্হিত হলেন। জানালেন তারা নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছেন কিন্তু নিবন্ধনের শর্ত পূরন করতে না পারায় এখনো নিবন্ধন পান নাই। রোগীদের নিবন্ধন বহিঃ সংরক্ষণ না করা, কর্তব্যরত নার্স ও স্টাফদের বিষয়ে এবং নিবন্ধন না পেয়ে প্রতিষ্ঠানটিতে কেন চিকিৎসা সেবা প্রদান করছেন এ বিষয়ে কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। অপরাধ ও সীমাবদ্ধতার কথা স্বীকার করলেন ও ক্ষমা চাইলেন। আবু বকরের প্রসংগে কথা বলতেই অপ্রস্তুত হয়ে সব অস্বীকার করলেন। বললেন আবু বকর সকল পাওনা পরিশোধ করেছেন। তিনি তার রোগী নিয়ে যেতে পারেন। কিন্তু পূর্বে পরিশোধিত টাকা সম্পর্কে জানতে চাইলে ম্যানেজার সাহেব বললেন ফিজিওথেরাপিস্টের প্রতিদিনের চার্জ ১,০০০ টাকা ফিজিওথেরাপিস্ট নিজে নিয়েছেন এবং পরীক্ষা নিরীক্ষাও ফিজিওথেরাপিস্ট সাহেবের কথামত করা হয়েছে। তারা শুধু রোগীর সেবাযত্ন করে থাকেন। ফিজিওথেরাপিস্ট সাহেব না থাকায় এই গোঁজামিলি গল্পের সমাধান করতে পারলাম না। ডেপুটি সিভিল সার্জন মহোদয় অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, পর্যাপ্ত স্থানের অভাব, সার্বক্ষণিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার না থাকা সর্বপরি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন না থাকায় মেডিকেল প্র্যাকটিস এবং বেসরকারি ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরী (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২ এর ০৮ ধারা লংঘন এবং রোগীদের কোন নিবন্ধন বহিঃ সংরক্ষণ না করায় একই আইনের ০৬ ধারা লংঘনের দুটি অভিযোগ আনলেন। অপরাধ মোবাইল কোর্টের সন্মুখে সংঘটিত হওয়ায় এবং অভিযুক্ত তা স্বীকার করায় একই আইনের ১৩(২) ধারা মতে দুটি পৃথক অপরাধে সর্বমোট ১০,০০০ টাকা অর্থদন্ড অনাদায়ে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করা হয়। অভিযুক্ত তাৎক্ষণিক জরিমানা পরিশোধ করায় তাকে মুক্তি দেয়া হয়। গল্প এখানেই শেষ নয়। ঐদিনই বরিশালের মেডিনোভা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মোবাইল কোর্ট পরিচালনাকালে যা উদঘাটিত হলো তা আরও হতাশাজনক। নিবন্ধনবিহীন ও অপেশাদার-অদক্ষ টেকনেশিয়ান শতশত রোগীর সিটিস্ক্যান এক্স-রে সহ বিভিন্ন পরীক্ষা করছেন। প্রতারিত হচ্ছে অসহায় রোগীরা। ঐ ডায়াগনস্টিক সেন্টারটিকেও একই আইনে ১০,০০০ টাকা অর্থদন্ড প্রদান করা হয়। একই অবস্থা নগরীর গ্রীণভিউ ডায়াগনস্টিক সেন্টার, হেলফকেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মেট্রো ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও স্কয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সকলকেই মোবাইল কোর্টের আওতায় অর্থদন্ড প্রদান করা হয়। কিন্তু প্রশ্ন থেকে গেল মানব জীবন নিয়ে এইরকম নিষ্ঠুর খেলা ও প্রতারণার  শেষ কোথায়? আবু বকরকে হয়ত আর ১,০০,০০০ টাকা দিতে হলো না এবং হালিমাকে নিয়ে হয়ত আবু বকর স্বরূপকাঠী চলে যেতে পেরেছেন। কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আবু বকররা প্রতারিত হচ্ছেন, হালিমারা ভুল চিকিৎসা সেবা পাচ্ছেন।  তাই এসকল প্রতারণা বন্ধে স্বাস্থ্য বিভাগকে সাথে নিয়ে সংশ্লিষ্ট আইন প্রচার করে জনসচেতনতা তৈরী করা এবং ব্যাপক ও বিস্তৃত আকারে মেডিকেল প্র্যাকটিস এবং বেসরকারি ক্লিনিক ও ল্যাবরেটরী (নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাদেশ ১৯৮২ অনুসারে মোবাইল কোর্ট বিশেষত  ই-মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা উচিত। ই-মোবাইল কোর্ট স্বচ্ছ ও নির্ভুল মোবাইল কোর্ট সম্পাদন নিশ্চিত করবে এবং জনমনে আস্থা অর্জিত হবে। তবেই হয়ত আবু বকরের মত আর কেউ প্রতারিত হবে না।




 প্রিন্ট